চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে যাওয়া ও স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে যেখানে দিনে তিন বেলা খাবার জোগাড় করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে ঢাকার বাড়িওয়ালাদের বাড়ি ভাড়া আদায়ের চাপে পড়ে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন পছন্দের এ শহর ছেড়ে তাদের গ্রামে ফিরে যেতে।
ভাড়াটিয়া পরিষদ নামে ভাড়াটিয়াদের এক প্ল্যাটফর্ম জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে চাকরি বা আয়ের অন্যান্য উৎস হারানোর ফলে বাড়ি ভাড়া এবং প্রতিদিনকার খরচ মেটাতে না পেরে সব মালামাল নিয়ে এ পর্যন্ত ৬০ হাজারেরও বেশি ভাড়াটে রাজধানী ছেড়েছেন।
এছাড়া অন্যান্য অনেক বেকার মানুষ হয় ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বা তাদের অলংকার এবং আসবাবসহ মূল্যবান জিনিসপত্র বিক্রি করে বাড়ি ভাড়া প্রদানের চেষ্টা করছেন বলে জানায় সংগঠনটি।
শিক্ষার্থী, রিকশা চালক, পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর, হকার, হোটেল-রেস্তোঁরার কর্মচারী, নির্মাণ শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন খাতে যুক্ত অন্য নিম্ন আয়ের অনেক মানুষই তাদের বাড়ির ভাড়া দেয়ার ক্ষমতা হারিয়েছেন।
বাড়ি ভাড়াই যাদের একমাত্র আয়ের উৎস এমন অনেক বাড়িওয়ালাও সমস্যায় পড়েছেন, কারণ করোনাভাইরাসের কারণে অনেক ভাড়াটিয়াই ভাড়া দেয়া বা বাড়ি খালি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, উপার্জনের উৎস হারিয়ে অনেকে রাজধানী ছেড়ে চলে যাওয়ায় এখন নগরীর বাড়িরগুলোর সামনে হাজারও টু-লেট নোটিস ঝুলছে।
তিনি বলেন, তাদের অভ্যন্তরীণ জরিপ অনুযায়ী জুন মাসের মধ্যেই ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন, যাদের মধ্যে বেশির ভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সাথে জড়িত। আর চলতি মাসের শেষের দিকে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে এক লাখে।
সুলতান বলেন, এ সংকাটকালে ভাড়া দিতে না পারায় অনেক বাড়ির মালিকরাই তাদের ভাড়াটিয়াদের সাথে খারাপ আচরণ করছেন। অনেক সময় ভাড়াটিয়াদের মূল্যবান জিনিসপত্র আটকে রেখে তাদের ভাড়া বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন বাড়িওয়ালারা।
এমন পরিস্থিতিতে দরিদ্র, অসহায় ও বেকার ভাড়াটিয়াদের এপ্রিল, মে ও জুন- এ তিন মাসের বাড়ি ভাড়া ও পরিষেবা বিল মওকুফ করার নির্দেশনা চেয়ে সোমবার হাইকোর্টে রিট আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি।
ভাড়াটিদের দুর্দশার বিষয়ে সরকারের নীরবতাকে দুঃখজনক উল্লেখ করে সুলতান বলেন, ‘অসহায় ভাড়াটিদের বর্তমান পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সরকার ঋণের ভিত্তিতে একটি প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারে। এছাড়া বাড়িওয়ারাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বাড়ি ভাড়া মওকুফের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা যেতে পারে।’
গত দুই দশকে ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া ৪০০ গুণ বেড়েছে উল্লেখ করে সুলতান বলেন, বাড়িওয়ালারা প্রতি বছর অস্বাভাবিকভাবে ভাড়া বাড়িয়ে বছরের পর বছর ধরে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন।
‘এ সংকটকালীন সময়ে বাড়িওলাদের উচিত ভাড়াটিয়াদের প্রতি যথেষ্ট সদয় হওয়া এবং তাদের বাড়ি খালি করতে বাধ্য করার পরিবর্তে ভাড়া প্রদানের সময় দেয়া,’ যোগ করেন সুলতান।
রাজধানীর বাড়ির মালিকদের নির্বিচারে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করার জন্য ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব জানান, রাজধানীতে লাখ লাখ মানুষ বাস করেন। মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সাথে জড়িত নিম্ন আয়ের মানুষরা বেকার হয়ে পড়েছেন এবং শহরে তাদের অস্তিত্বই এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে প্রতিদিন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ চাকরির আশায় ঢাকায় আসতেন। তাদের একটি বিশাল সংখ্যা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সাথে জড়িত এবং তাদের বেশির ভাগই সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থায় তালিকাভুক্ত নয়।’
অনেক লোকই শহরে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন বলে উদাহরণ দিয়ে হাবিব বলেন, ‘এ শ্রমিকরা সাধারণত কিছু কন্ট্রাকটরের মাধ্যমে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বিভিন্ন নির্মাণ কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ জন্য তারা কোনো সংস্থায় তালিকাভুক্ত হননি এবং তাদের ভালো মন্দ দেখার জন্যও কেউ দায়বদ্ধ নয়।’
তিনি বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে সীমিত আকারে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু হলেও অনেকেই চাকরি ফিরে না পাওয়ায় রাজধানীতে অবস্থান করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
‘সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা অসহায়দের খাদ্য সহায়তা সরবরাহ করলেও, তাদের বাড়ির ভাড়া কে দেবে? এ জন্যই অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন এবং আগামী দিনগুলোতেও অনেকে একই কাজ করতে বাধ্য হবেন। যদিও সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তবে এ লোকেরা সেটির বাইরে রয়েছেন,’ যোগ করেন হাবিব।
তিনি আরও জানান, করোনাভাইরাস বিপর্যয় মোকাবিলা করতে অনেক বেসরকারি সংস্থা ছাঁটাইয়ের নীতি গ্রহণ করায় প্রাতিষ্ঠানিক খাতেরও অনেক মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন।
সরকারের উচিত এখন বেকারদের জন্য একটি বেলআউট প্যাকেজ ঘোষণা করে তাদের সহায়তা করা যাতে তারা আংশিকভাবে অন্তত তাদের বাড়ি ভাড়া প্রদান করতে পারেন, বলেন হাবিব।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের উচিত বাড়িওয়ালাদের হোল্ডিং ট্যাক্স এখন মওকুফ করা যাতে তারা অসহায় ও বেকার ভাড়াটিয়াদের কিছুটা হলেও বাড়ি ভাড়া মওকুফ করতে পারেন।
বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের মধ্যে সম্পর্ক এবং একে অপরের প্রতি দায়িত্ব নির্ধারণ করে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ভাড়া নীতিমালা কার্যকর করার তাগিদ দেন নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ মানুষ পুরোপুরি বা আংশিকভাবে উপার্জনের পথ হারিয়েছেন এবং তাদের বেশির ভাগই শহরে বাস করেন।
‘এখন তাদের পক্ষে পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা এবং বাড়ির ভাড় পরিশোধ করা কঠিন,’ যোগ করেন তিনি।
করোনাভাইরাস রোধে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পুনরায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করাই এসব সমস্যার সমাধান।
‘সরকার তার সামাজিক সুরক্ষা জাল এবং নগদ প্রদান কর্মসূচি আরও বাড়াতে পারে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালা উভয়কেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করার জন্য সহজ শর্তে ঋণ সরবরাহ করতে পারে,’ বলেন মুস্তাফিজুর রহমান।